বাংলাদেশে হাইব্রিড (hybrid) ধানের উৎপাদন বাড়ছে। খবরটি বেরিয়েছে বাংলাদেশের একটি ইংরেজি পত্রিকা, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের চাষ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।
বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের চাষ মূলত হয় সেচ নির্ভর বোরো মৌসুমে। গত বছর (২০২০-২১), বোরো মৌসুমে ১.২১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ করা হয়েছিল। এটি ছিল সারা দেশের মোট বোরো জমির প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৪.৮%)। একই সময় ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর এবং খুলনা বিভাগের বারোটি জেলায় শতকরা ৫১ ভাগ জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হয়েছে। পাঁচ বছর আগে (২০১৬-১৭) বোরো মৌসুমে সারা দেশে ০.৬৬ মিলিয়ন হেক্টর, অর্থাৎ শতকরা ১৪ ভাগ বোরো জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ করা হয়েছিল। কৃষি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধানের চাষাবাদ দিন দিন আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। তবে বৃষ্টিনির্ভর আউশ এবং আমনের ক্ষেত্রে হাইব্রিড ধানের চাহিদা এখনো তেমন বাড়েনি। বর্তমানে আউশ আমন এবং বোরো এই তিন মৌসুম মিলিয়ে শতকরা ১২ ভাগ জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৩০ সাল নাগাদ এটা শতকরা ২০ ভাগে উন্নীত হতে পারে।
কৃষকরা হাইব্রিড ধানের দিকে ঝুঁকছেন, তার মূল কারণ হলো হাইব্রিড ধানের উৎপাদন দেশে বহুল প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের চেয়ে বেশি। দেশের উচ্চফলনশীল ধান গুলো হলো ইনব্রেড (inbred) জাতের ধান। গড়পড়তা হিসেবে হাইব্রিড ধান ইনব্রেড ধানের চেয়ে শতকরা দশ থেকে পনেরো ভাগ বেশি ফলন দেয়। তবে ক্ষেত্র বিশেষে এর কিছুটা কমবেশি হতে পারে।
এখানে সবার বোঝার সুবিধার্থে, ইনব্রেড ধানের সাথে হাইব্রিড ধানের মূল পার্থক্যটা একটু বিস্তারিত বলছি। আমাদের দেশে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ হয়ে আসছে। এই উচ্চ ফলনশীল ধানগুলো ইনব্রেড জাতের ধান। এই পদ্ধতিতে দুটো ভিন্ন জাতের ধান গাছের মধ্যে কৃত্রিম ভাবে সংকরায়ন করে দুটো জাতের কাম্য বৈশিষ্ট্যগুলো একটি অভিন্ন জাতের মধ্যে সংমিশ্রণ করা হয়। যেমন ধরুন, একটি জাতের ধানের মধ্যে রয়েছে উচ্চ ফলনশীলতা, আর অন্য একটি জাতের ধানের মধ্যে রয়েছে লবণাক্ততা সহিষ্ণুতা। প্ল্যান্ট ব্রিডাররা এই দুটো ধানের জাতের মধ্যে সংকরায়ন করে একটি নতুন জাতের লবণাক্ততা সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করার চেষ্টা করতে পারেন। এই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় প্রজন্ম (F2) থেকে কাম্য গাছগুলোকে বাছাই করে স্বপরাগায়নের (self fertilization) মাধ্যমে ধাপে ধাপে নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়। দুটো ভিন্ন জাতের মধ্যে সংকরায়ন করার ফলে দ্বিতীয় প্রজন্মের ধান গাছের মধ্যে অনেক নুতন ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। সেখান থেকেই প্ল্যান্ট ব্রিডাররা তাঁদের কাম্য গাছগুলো বাছাই করে পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যান। এভাবে বেশ কয়েকটি প্রজন্মে বাছাইয়ের পর গাছগুলো একটি সুষম (uniform) এবং স্থিত (stable) অবস্থায় চলে আসে। সেখান থেকেই একটি নতুন ইনব্রেড ধানের জাতের জন্ম হয়। এটি একটি সময় সাপেক্ষ দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে এসব নতুন জাতের ধান থেকে কৃষক সহজেই পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন। এটি হলো উদ্ভিদ প্রজননের একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। পৃথিবীর বেশিরভাগ আধুনিক ধানের জাত এই পদ্ধতিতেই উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমাদের দেশে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গত ৫০ বছরে একশটিরও বেশি উচ্চ ফলনশীল ইনব্রেড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় এসব উচ্চ ফলনশীল ইনব্রেড ধানের জাত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
অন্যদিকে, হাইব্রিড কথাটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। এক্ষেত্রে দুটো ভিন্ন জাতের মধ্যে সংকরায়ন করার পর প্রথম প্রজন্মকেই (F1) বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবহার করা হয় না। সাধারণত দুটো ভিন্ন জাতের মধ্যে সংকরায়ন করলে প্রথম প্রজন্ম ফলনের দিক দিয়ে বাবা মাকে ছাড়িয়ে যায়। একে বিজ্ঞানীরা বলেন, হাইব্রিড ভিগর (Hybrid vigour)। এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে প্ল্যান্ট ব্রিডাররা হাইব্রিড জাতের ফসল উদ্ভাবন করেন। হাইব্রিড ফসলগুলোর উৎপাদন বেশি হলেও কৃষকরা এ থেকে বীজ সংরক্ষণ করতে পারেন না। কারণ হাইব্রিড বীজ পরবর্তী প্রজন্মে স্থিতিশীল থাকে না। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মে ভালো ফসল হয় না। মোদ্দা কথা হলো, হাইব্রিড বীজ একবারই ব্যবহার করা যায়। হাইব্রিডের আরেক সমস্যা হলো, এটির বীজ উৎপাদন করাও সহজ নয়। এজন্য বিশেষ কিছু ধরনের কলাকৌশল রয়েছে, যেটি আয়ত্ত করাটা কৃষকের পক্ষে সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, হাইব্রিডের ব্যাপারে বাণিজ্যিক বীজ কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বেশি। তার কারণ হলো, হাইব্রিড বীজের জন্য কৃষককে প্রতিবছর কোম্পানির উপরে নির্ভর করতে হয়। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে এটি নিঃসন্দেহে একটি লাভজনক ব্যবসা।
স্ব-পরাগায়িত উদ্ভিদ হওয়ায়, ধানের ক্ষেত্রে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করাটা সহজ নয়। এর জন্য প্রধানত তিন ধরনের ধান গাছের প্রয়োজন হয়। প্রথমটি হলো, নপুংসক বা male sterile গাছ। একে বলা হয়, A line। এই গাছের ফুলে পরাগরেণু তৈরি হয় না, ফলে এই গাছটি নিজ থেকে বীজ উৎপাদন করতে পারে না। এই A লাইনকে অন্য একটি উচ্চ ফলনশীল ধান গাছের মাধ্যমে পরাগায়িত করে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করা হয়। এই অন্য ধান গাছটিকে বলা হয়, রেস্টোরার (Restorer) বা পুনরুদ্ধারকারী। সংক্ষেপে বলা হয় R লাইন। হাইব্রিড বীজ উৎপাদন পদ্ধতিটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার হয় তৃতীয় আরেক ধরনের ধানগাছ। এই তৃতীয় ধরনের গাছটিকে বলে, মেইনটেইনার (Maintainer) বা রক্ষণাবেক্ষণকারী। সংক্ষেপে একে বলা হয়, B লাইন।জেনেটিক্যালি এটি হুবহু A লাইনের মত হলেও, এটি পরাগরেনু উৎপাদন করতে পারে। B লাইনটির কাজ হলো A লাইনের বংশ-পরম্পরা রক্ষা করা। A লাইন নিজ থেকে A লাইন তৈরি করতে পারে না, এজন্য B line এর প্রয়োজন হয়। A, B এবং R, এই তিন ধরনের লাইন ব্যবহার করে হাইব্রিড ধান বীজ উৎপাদনের পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেছিলেন চীন দেশের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তাঁর নাম ইউয়ান লং পিঙ। তাঁকে বলা হয় হাইব্রিড ধানের জনক। তাঁর হাত ধরেই সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে চীনদেশে হাইব্রিড ধানের সূচনা হয়েছিল। বর্তমানে চীন দেশে এই প্রযুক্তির আরো অনেক উন্নতি হয়েছে। তিন লাইনের জায়গায় দুই লাইন ব্যবহার করে হাইব্রিড প্রযুক্তিকে আরো সহজ করা হয়েছে।
হাইব্রিড প্রযুক্তি ব্যবহার করেই চীন দেশ পৃথিবীর মাত্র ১০ ভাগ কৃষি জমি ব্যবহার করে, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০ ভাগ মানুষকে অন্ন যোগাচ্ছে। এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে চীন দেশের ধানের জমির পরিমাণ কমেছে শতকরা ১৪ ভাগ কিন্তু উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ৪৪ ভাগ। বলাই বাহুল্য, চীন দেশ হাইব্রিড ধানের উৎপাদনে বিশ্বের এক নম্বর স্থানে রয়েছে।
হাইব্রিড ধানের সবচেয়ে বড় উপকারিতা হলো, এটি উচ্চ ফলনশীল ইনব্রেড ধানের চেয়ে বেশি ফলন দেয়। ধান উৎপাদনের খরচ বিবেচনা করলে, আমাদের দেশের কৃষকরা হাইব্রিড ধানের দিকে ঝুঁকবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর সমস্যা হলো, কৃষক হাইব্রিড ধানের বীজ পরবর্তী ফসলের জন্য সংরক্ষণ করতে পারেন না।
বাংলাদেশে এখন যেসব হাইব্রিড ধান উৎপাদিত হচ্ছে, তার অধিকাংশই চাইনিজ হাইব্রিড। অবশ্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কয়েকটি হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু বাজারের তীব্র প্রতিযোগিতায় সেগুলো বিদেশি হাইব্রিডের সাথে পেরে উঠছে না। এদিকে হাইব্রিড বীজের চাহিদা বাড়ায়, কোম্পানিগুলো বিদেশ থেকে অধিক মাত্রায় হাইব্রিড বীজ আমদানি করে বাজারজাত করছেন।
আমদানির পাশাপাশি বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে হাইব্রিড ধান বীজের উৎপাদন শুরু হয়েছে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এবং টাঙ্গাইলের মধুপুরে বেসরকারি পর্যায়ে হাইব্রিড বীজ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বগুড়ার শেরপুরেও হাইব্রিড বীজ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে হাইব্রিড ধান বীজের অর্থনৈতিক বাজার মূল্য ১.৬ বিলিয়ন টাকা। ভবিষ্যতে এটা আরো বৃদ্ধি পাবে।
যদিও কিছু কিছু বীজ কোম্পানি দেশে হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদন করছেন, কিন্তু প্রযুক্তিগত ভাবে তারা এখনো বিদেশি কোম্পানির উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হাইব্রিড ধান চাষের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তার পাশাপাশি আমাদের ধান বীজের নিরাপত্তার কথাও চিন্তা করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার পূর্ব শর্ত হলো বীজের নিরাপত্তা। এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, একটি কোম্পানিকে সর্বোচ্চ ছয় বছর হাইব্রিড বীজ আমদানি করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে, কিন্তু তারপর ঐ কোম্পানিকে দেশেই সেই হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করতে হবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, বর্তমানে দেশে ২২৩ টি হাইব্রিড জাতের ধান চাষের অনুমতি রয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ২৪ টি হাইব্রিড জাতের ধান বীজ দেশে উৎপাদিত হয়।
হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে মূলত অনুকূল আবহাওয়ার জন্য। প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য নয়। একজন প্ল্যান্ট ব্রিডার হিসেবে আমি মনে করি, খাদ্য নিরাপত্তা, বীজের নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে প্রচলিত ইনব্রেড ধানের গবেষণার প্রতি আমাদের অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন হবার ফলে ধান চাষ করার পরিবেশ ক্রমেই প্রতিকূল হচ্ছে। ধান চাষের জমি কমে যাচ্ছে। এর জন্য দরকার নতুন নতুন উদ্ভাবনী গবেষণার মাধ্যমে ইনব্রেড ধানের ফলনকে বাড়িয়ে হাইব্রিড ধানের সমমানে নিয়ে যাওয়া। ব্যাপারটি দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। এ ব্যাপারে পৃথিবীর নানা দেশে এখন গবেষণা চলছে। এখানে একটি গবেষণাপত্রের লিংক দেওয়া হলো:
https://www.nature.com/articles/s41598-020-65574-0
হাইব্রিড ধানের ব্যাপারে বাংলাদেশের ধান বিজ্ঞানীদের সুচিন্তিত মতামত আশা করছি।
Comments