কোয়ান্টাম টানেলিং

হ্যারি পটারকে নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। হ্যারির জন্ম হয়েছিলো একটি উইজার্ড পরিবারে। সেজন্য তার মধ্যে বেশ কিছু অলৌকিক ক্ষমতা ছিলো। হ্যারি পটারকে নিয়ে নির্মিত প্রথম সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখা যায় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের শক্ত দেয়াল ভেদ করে হ্যারি দিব্যি ওপাশে চলে গেল।প্রথমবার অবশ্য হ্যারি সেটি পারেনি। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সে সফল হয়েছিলো। হ্যারি পটারের গল্পটি নিছকই একটি কল্প কাহিনি। কল্পনায় আশ্চর্য অনেক কিছুই ঘটে। তাই এসব কাল্পনিক বিষয় নিয়ে আমরা বিশেষ মাথা ঘামাই না। 

কিন্তু যদি প্রশ্ন করি,  আসলেই কি কঠিন দেয়ালকে অক্ষত রেখে অন্যপাশে চলে যাওয়া সম্ভব? এর সহজ উত্তর হলো, বাস্তব জগতে এটি কখনোই সম্ভব নয়, কল্পনার জগতে হতে পারে। কিন্তু কোন কোয়ান্টাম পদার্থ বিজ্ঞানীকে যদি প্রশ্নটি করা হয় তাহলে তাঁর উত্তরটি একটু ভিন্ন হতে পারে। তিনি হয়তো বলবেন, হলেও হতে পারে, সম্ভাবনাটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ কোয়ান্টাম পদার্থ বিজ্ঞানীরা জানেন, আমাদের পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমান জগতে এটি সম্ভব না হলেও বস্তুকণার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম জগতে এটি খুবই সম্ভব। একে বলে, কোয়ান্টাম টানেলিং। 

ব্যাপারটা একটু উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করছি। মনে করুন, একটি টেনিস বলকে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হলো। তাহলে কি হবে? বলটি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে, তাই না?  যতবারই বলটি
ছোঁড়া হবে ততোবারই বলটি দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে। বলটি কখনোই দেয়াল ভেদ করে অন্য পাশে চলে যাবে না। এটি হলো আমাদের দৃশ্যমান জগতের নিয়ম। আমরা এই নিয়মেই অভ্যস্ত। 

কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম জগতের নিয়ম কানুন গুলো বড়ই অদ্ভুত। এই জগতে কোন বস্তুকণাকে যদি শক্ত দেয়ালের দিকে বারবার ছুঁড়ে দেয়া হয়, তাহলে প্রতিবারই সে কিন্তু ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে না। মাঝে মাঝে তার দেয়াল ভেদ করে অন্যদিকে চলে যাবার ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে। ‌এর কারণ হলো, বস্তুকণারা শুধুমাত্র কণা নয়, একই সাথে তারা তরঙ্গও বটে। এই দ্বৈত চরিত্রের জন্য কোন বস্তুকণার অবস্থান সুনির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব নয়। ‌বস্তুকণার অবস্থানের এই অনিশ্চয়তার ব্যাপারটি সর্বপ্রথম গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। একে বলা হয়, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র। 

বস্তুকণার গতি প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয় ওয়েভ ফাংশন সমীকরণ দিয়ে। ১৯২৬ সালে অস্ট্রিয়ান পদার্থ বিজ্ঞানী আরভিন শ্রোডিঙ্গার এই সমীকরণটি আবিষ্কার করেন।
বস্তুকণার ওয়েভ ফাংশন যখন কোন দেয়ালে আঘাত করে তখন এর পুরোটাই প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে না। ‌এর কিছুটা অংশ দেয়ালের ভেতরে ঢুকতেও পারে। কিন্তু তখন তার তরঙ্গের বিস্তারও  কমতে থাকে। কিন্তু ওয়েভ ফাংশন সমীকরণ অনুযায়ী এটা কখনোই শূন্য হয়ে যায় না। বস্তুকণার ওয়েভ ফাংশানের সব সময়ই একটি "নন জিরো প্রবাবিলিটি" থাকে।  তার মানে হলো, কোন কোন সময় বস্তুকণার ওয়েভ ফাংশন দেয়াল ভেদ করে অন্যপাশে চলে যেতে পারে। এটাই হলো কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের মোদ্দাকথা। এর ফলে বস্তুকণা কোন শক্ত বাধা অতিক্রম করতে পারে। বস্তুকণা যত ছোট হবে তার কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের সম্ভাবনা তত বেশি হবে। যেমন, ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম টানেলিং সবসময়ই হচ্ছে। তবে বস্তুকণা বড় হলে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। সেজন্য আমাদের পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমান জগতে কোয়ান্টাম টানেলিং আমরা দেখতে পাই না। ‌ 

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো,  কোয়ান্টাম টানেলিং না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ এবং বিকাশ কোনটাই হতো না। কারণ হলো, কোয়ান্টাম টানেলিং না হলে সূর্য একটি নক্ষত্র হিসেবে প্রজ্বলিত হতে পারতো না। বিষয়টি একটু খুলেই বলি। সূর্য মূলত হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে তৈরি। সৌরশক্তির উৎস হলো হাইড্রোজেনের পরমাণু। সূর্যের অভ্যন্তরে হাইড্রোজেন পরমাণু ক্রমাগত হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হচ্ছে। একে বলা হয়, পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যে বিপুল পরিমান শক্তি উৎপন্ন হয় সেটাই হলো সৌরশক্তির আধার। এই সৌরশক্তির অতি সামান্য অংশ পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। তার উপর নির্ভর করেই পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী এবং উদ্ভিদ বেঁচে আছে‌। 

হাইড্রোজন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে রয়েছে একটি প্রোটন কণা। ‌এর চার্জ হলো পজেটিভ অর্থাৎ ধনাত্মক। ফিউশন প্রক্রিয়ায় চারটি ধনাত্মক প্রোটন কণা একত্রিত হয়ে একটি হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস গঠন করে। কিন্তু হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর চারটি প্রোটন কণার সম্মিলিত ভরের চেয়ে ০.৭% কম হয়।  এই অতি সামান্য ভর সরাসরি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত সমীকরণে (E =mc^2 ) দেখিয়েছেন, অতি সামান্য ভর থেকেই বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হতে পারে। সূর্যের অভ্যন্তরে সেটাই ঘটছে। শুধু আমাদের সূর্য নয়, মহাবিশ্বের বেশিরভাগ নক্ষত্রের শক্তির উৎস হলো হাইড্রোজেনের হিলিয়ামে রূপান্তরিত হওয়ার পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়া। 

আগেই বলেছি, ফিউশন প্রক্রিয়ায় ধনাত্মক প্রোটন কণাগুলোকে একত্রিত হয়। কিন্তু ধনাত্মক প্রোটন কণাগুলোর তো পরস্পরকে বিকর্ষণ করার কথা, তারা একত্রিত হয় কিভাবে? ধনাত্মক প্রোটন কণাগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ করে যে বাধার সৃষ্টি করে তার নাম হলো,  কুলম্ব ব্যারিয়ার। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, সূর্যের অভ্যন্তরে প্রচন্ড চাপ এবং তাপ থাকলেও সেটা কুলম্ব ব্যারিয়ারকে অতিক্রম করে ফিউশন প্রক্রিয়া ঘটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এখানে কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের একটি প্রধান ভূমিকা রয়েছে। প্রোটন কণাগুলো শুধুমাত্র মাত্র কণা নয়, একই সাথে তারা তরঙ্গ ও বটে।  সূর্যের অভ্যন্তরে  প্রোটন তরঙ্গের ওয়েভ ফাংশন কুলম্ব ব্যারিয়ারের বাঁধাকে অতিক্রম করে ফিউশন প্রক্রিয়া ঘটাতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, কোয়ান্টাম টানেলিং না হলে সূর্যের অভ্যন্তরে ফিউশন প্রক্রিয়া কখোনই ঘটতো না। 

যদিও কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের প্রবাবিলিটি বা সম্ভাব্যতা খুবই কম, তবুও সূর্যের অভ্যন্তরে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি প্রোটনকে একত্রিত করে ফিউশন প্রক্রিয়া ঘটনার জন্য সেটা যথেষ্ট। শুধু আমাদের সূর্য নয়, মহাবিশ্বের অধিকাংশ নক্ষত্রই কোয়ান্টাম টানেলিংয়ের ফলেই  প্রজ্বলিত হতে পেরেছে। কোয়ান্টাম টানেলিং না হলে মহাবিশ্ব হতো অন্ধকার এবং আমাদেরও কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। 

এরপর শীতের দিনে বাইরে বসে রোদ পোহাবার সময় কোয়ান্টাম টানেলিংকে ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না 

কপিরাইট: তানভীর হোসেন।

Comments