আজকাল জিনোম এডিটিং বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জিনোম এডিটিং করে বহু জটিল রোগের সমাধান করা সম্ভব হবে। মানুষের আয়ুও বহু গুনে বাড়িয়ে ফেলা যাবে। কৃষিক্ষেত্রে আরেকটি সবুজ বিপ্লব ঘটানোও অসম্ভব কিছু নয়। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে অদূর ভবিষ্যতে বায়োলজিক্যাল মিরাকেল ঘটাবে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি। কিন্তু এই প্রযুক্তিটি আসলে কি? কেন একে নিয়ে এত আলোচনা।
একে বুঝতে হলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে ডিএনএ অণুর গঠণ বিন্যাসকে। জীবজগতের বংশগতির ধারক ও বাহক হলো ডিঅক্সি রাইবো নিউক্লিক এসিড বা ডিএনএ (DNA) অণু । জীবকোষের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোসমের মধ্যেই মূলত এর অবস্থান। ডিএনএ অণুগুলো বেশ বড়ো আকারের হয়। দুটো লম্বা সুতোর মতো পরস্পরকে এরা জড়িয়ে থাকে। তাদের এই জড়িয়ে থাকা কাঠামোটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডিএনএ ডবল হিলিক্স। এই ডবল হিলিক্স কাঠামোটি তৈরী হয়েছে ডি অক্সি রাইবোস, ফসফেট এবং চার ধরণের নাইট্রোজেন বেইস (base) দিয়ে।
ডিএনএর কাজ হলো জীব জগতের জেনেটিক কোডকে ধারণ করা। জেনেটিক কোডের বর্ণমালায় রয়েছে ডিএনএর চারটি নাইট্রোজেন বেইস। এদেরকে নামের চারটি আদ্যক্ষর (ATGC) দিয়ে প্রকাশ করা হয়। এই চারটি মাত্র "অক্ষরের" সামগ্রিক বিন্যাসে এককোষী ব্যাকটেরিয়া সহ যাবতীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর জিনোম রচিত হয়েছে। জিনোম বলতে কোন জীবের সামগ্রিক ডিএনএ বিন্যাসকে বোঝায়। জিনোমের আকার নির্ভর করে নাইট্রোজেন বেইসের সংখ্যার উপর। মানুষের জিনোমে প্রায় তিন বিলিয়ন নাইট্রোজেন বেইস জোড় (base pair) রয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, জিনোমের ডিএনএর পুরোটাই কিন্তু জিন (gene) নয়। জিন বলতে জিনোমের সেই অংশকেই বোঝায় যা নির্দিষ্ট কোন প্রোটিন তৈরীর কোডকে ধারণ করে। জিনোমের বেশির ভাগ অংশই হলো কোডবিহীন ডিএনএ।সেজন্য জিনোমের ভেতর থেকে জিন গুলোকে রীতিমতো খুঁজে বের করতে হয়। আর এই খুঁজে বের করার কাজটি বেশ কঠিন। মানুষের জিনোমে খুঁজে পাওয়া গেছে ২০ হাজারের মতো জিন। এই জিন গুলো সম্মিলিত ভাবে মানবের সকল বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন জিনের পরিবর্তন করে জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলোও পরিবর্তন করা সম্ভব। এটি অনেকটা ওয়ার্ড প্রসেসরে লেখা এডিট করার মতো ব্যাপার। আমরা যেমন লেখার ভেতর কোনো শব্দ বা অক্ষরকে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে পারি, তেমনিভাবে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন যা দিয়ে তাঁরা জিনোমের ভেতরে ইচ্ছেমতো জিনের পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। এই প্রযুক্তির নাম হলো, জিনোম এডিটিং।
বর্তমানে জিনোম এডিটিং করার তিনটি প্রধান প্রযুক্তি রয়েছে। তার মধ্যে দুটি প্রযুক্তি একটু পুরনো ( ZFN এবং TALEN)। আর একটি প্রযুক্তি হলো অপেক্ষাকৃত নতুন। এই নতুন প্রযুক্তিটির নাম হলো ক্রিসপার/ক্যাস নাইন (CRISPR/Cas9) । এই প্রযুক্তিটি আবিষ্কার হবার পর একে নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুবই আশাবাদী। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা এখন খুব সহজেই ফলপ্রসূভাবে জিন এডিটিং করে জিনোমের ভেতরে কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে পারবেন। অনেকে একে বলছেন, "জৈবপ্রযুক্তিতে শতাব্দীর সবচেয়ে সেরা আবিষ্কার"। এই আবিষ্কারটির জন্য ২০২০ সালে দুইজন বিজ্ঞানীকে রসায়নে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এদের একজন হলেন ইম্যানুয়েল সার্পেন্টিয়ার এবং অপরজন হলেন জেনিফার ডোডনা।
এখন দেখে নেয়া যাক CRISPR/Cas9 প্রযুক্তিটি কিভাবে কাজ করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ব্যাক্টেরিয়ার জিনোমে কিছু কিছু সিকোয়েন্স আছে, যার মধ্যে অনেকগুলো পুনরাবৃত্তি থাকে। এদেরকে বলে ক্রিসপার (CRISPR এর পুরো নাম Clustered regularly interspaced short palindromic repeat)। এটি আসলে প্রকৃতিতে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরক্ষা হিসাবে কাজ করে। ব্যাকটেরিয়া যখন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন এই ক্রিসপার সিকোয়েন্স থেকে কিছু প্রোটিন উৎপন্ন হয়। এই প্রোটিনগুলো ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে। এই ক্রিসপার প্রোটিন গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে Cas9 । যদিও Cas9 প্রোটিনের কাজ হলো ভাইরাসকে আক্রমণ করা কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন একে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন কাজে লাগাচ্ছেন। আর এই কাজটি হলো জিনোম এডিটিং করা।
তাঁরা Cas9 প্রোটিনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন ছোট্ট একটি গাইড আর এন এ (gRNA) অণু। এই অণুটিতে মাত্র গোটা বিশেক বেইস জোড় (base pair) থাকে। এই গাইড আরএনএর কাজ হলো জিনোম এডিটিং করার জন্য টার্গেট জিনটিকে শনাক্ত করা। গাইড অণুটিকে এমনভাবে তৈরী করা হয় যাতে এটি শুধুমাত্র টার্গেট জিনটির সাথেই যুক্ত হতে পারে। আর টার্গেট জিনটি পাওয়া মাত্র Cas9 প্রোটিন জিনোমের ডিএনএকে কেটে দুভাগ করে ফেলে। তখন প্রাকৃতিক নিয়মেই ডিএনএ নিজেকে আবার জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে। আর এই সুযোগে বিজ্ঞানীরা সেখানে জুড়ে দিতে পারেন তাদের পছন্দের জিন অথবা নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন কোনো ক্ষতিকর জিনকে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে বিভিন্ন গবেষণাগারে CRISPR/Cas9 প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের জিনোম এডিটিং করা হচ্ছে। তবে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখনো অনেক বাধা নিষেধ রয়েছে।
CRISPR/Cas9 প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে গণচীন। এর কারণ হলো চীন দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রেগুলেশন অনেকটাই নমনীয়। সেই কারণে চীন দেশের বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তি বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ব্যাপক ব্যবহার করছেন। এমনকি মানুষের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রেও তারা এই প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই। একজন চীনা বিজ্ঞানী দাবি করেছেন তিনি মানব ভ্রূণে CRISPR/Cas9 প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি ক্ষতিকর জিনকে (CCR5) নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন। সেই এডিটিং করা ভ্রুণ থেকে একটি সুস্থ মানব শিশুর জন্ম হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে অবশ্য প্রচণ্ড সমালোচনা হয়েছে। মানুষের ক্ষেত্রে জিন এডিটিং করাকে অনেকে বাড়াবাড়ি মনে করছেন। তার এই কাজটি বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছে একটি গর্হিত কাজ হিসেবে।
পরবর্তীতে চীনা কর্তৃপক্ষ ওই বিজ্ঞানীকে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
উদ্ভিদ প্রজননের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধানের ফলন বাড়াতে এবং Amylose এর পরিমাণ কমাতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও CRISPR/Cas9 প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে।
মোদ্দা কথা হল CRISPR/Cas9 প্রযুক্তিটির ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি জিনোমের মধ্যে টার্গেট জিনকে খুব সহজেই শনাক্ত করে তার মধ্যে কাঙ্খিত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এজন্যই বিজ্ঞানীরা এর সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনা নিয়ে খুবই আশাবাদী।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আরেক ধরনের ক্রিসপার প্রোটিনের সন্ধান পেয়েছেন যার নাম হলো Cas13। এই প্রোটিনটি কাজ করে আরএনএ(RNA) অণুর এর উপর। শঙ্কার কথা হলো Cas13 প্রোটিনটি দিয়ে আরএনএ ভাইরাসের জিনোমকে পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। সুতরাং এর ব্যবহার সীমিত এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা বাঞ্ছনীয়।
বি:দ্র: বৈশ্বিক মহামারী COVID19 রোধে করোনা ভাইরাস SARS-CoV 2 সহজে চিহ্নিত করার জন্য CRISPR/Cas13 প্রযুক্তি ব্যবহারের একটি প্রক্রিয়া বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন। এর মাধ্যমে বর্তমানে বহুল প্রচলিত RT-PCR পরীক্ষার চেয়ে অনেক দ্রুত এবং কম খরচে COVID19 রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
Comments