গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের ঘটনা ঘটেছিলো। সে যুগের বিজ্ঞানীরা জানতেন, প্রাণের প্রধান উপাদান হলো একটি নিউক্লিক অ্যাসিড, যার নাম হলো, ডি-অক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ (DNA)। জীবকোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরে মূলত এর অবস্থান। ডিএনএর রাসায়নিক গঠন সম্বন্ধে জানলেও, এর ভৌত গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তখনও সঠিক ধারণা ছিল না।
১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক নামে দুজন বিজ্ঞানী সফলভাবে ডিএনএ অণুর ভৌত কাঠামোর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁরা বললেন, ডিএনএ অণু দুটো লম্বা সুতোর মতো পরস্পরকে পেঁচিয়ে থাকে। এই কাঠামোটির নাম দেয়া হলো, ডিএনএ ডবল হিলিক্স। এটি তৈরী হয়েছে ডি-অক্সি রাইবোস সুগার, ফসফেট এবং চার ধরণের নাইট্রোজেন বেইস দিয়ে। এই নাইট্রোজেন বেইসগুলোর নাম হলো অ্যাডেনিন, থায়মিন, গুয়ানিন এবং সাইটোসিন। এদেরকে নামের চারটি আদ্যক্ষর, ATGC দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ডবল হিলিক্স কাঠামোটির ভেতরে A জোড় বেঁধে থাকে T এর সাথে এবং G জোড় বেঁধে থাকে C এর সাথে।
কিন্তু কোষ বিভাজনের সময় একটি ডিএনএ অণু থেকে হুবহু আরেকটি ডিএনএ অণুর প্রতিলিপি কিভাবে তৈরি হয় সেটি নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে মতভেদ সৃষ্টি হলো। ওয়াটসন এবং ক্রিক বললেন, প্রতিলিপি তৈরি হবার সময় ডিএনএ ডবল হিলিক্স কাঠামোটি খুলে গিয়ে দুটো আলাদা ডিএনএ স্ট্র্যান্ডের সৃষ্টি হয়। দুটো স্ট্র্যান্ড থেকেই একটি করে নতুন ডিএনএ স্ট্র্যান্ড তৈরি হয়। তারপর একটি নতুন এবং একটি পুরনো স্ট্র্যান্ড মিলে আরেকটি ডিএনএ ডবল হিলিক্স কাঠামো সৃষ্টি হয়। এভাবে একটি ডিএনএ ডবল হিলিক্স থেকে দুটো ডবল হিলিক্স তৈরি হয়। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীই এই থিওরি মানতে রাজি হলেন না। তাঁদের মতে, ডিএনএ ডবল হিলিক্স কাঠামোটি এভাবে খুলে যেতে পারে না। তাঁরা বললেন, ডিএনএ সরাসরি আরেকটি নুতন ডবল হিলিক্স কাঠামোর প্রতিলিপি তৈরি করে। আবার আরেক দল বিজ্ঞানী বললেন, ডিএনএ ডবল হিলিক্সটি ভেঙে প্রথমে ছোট ছোট অনেকগুলো নতুন ডিএনএ ডবল হিলিক্সের প্রতিলিপি তৈরি হয় তারপর সেগুলো একত্রে জোড়া লাগে। মোদ্দা কথা হলো, ডিএনএ ডবল হিলিক্স কাঠামোটির প্রতিলিপি তৈরি হবার প্রক্রিয়াটি নিয়ে তিনটি ভিন্নমতের সৃষ্টি হলো।
সময়টা ছিল ১৯৫৮ সাল। সে সময় ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন তরুণ গবেষক ভাবলেন, ডিএনএ অণুর প্রতিলিপি তৈরি হবার প্রক্রিয়াটি নিয়ে গবেষণা করে দেখা যাক। এ দু'জন গবেষকের নাম, ম্যাথিউ মেসেলসন এবং ফ্রান্ক স্টাল। এরা দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার জন্য তাঁরা একটি অভিনব কিন্তু সহজ পরীক্ষার আশ্রয় নিলেন।
আগেই বলেছি, ডিএনএর ভেতর চার ধরনের নাইট্রোজেন বেইস থাকে। এই বেইসগুলো সাধারণ নাইট্রোজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত, যার পারমাণবিক ভর ১৪। মজার ব্যাপার হলো, প্রকৃতিতে নাইট্রোজেনের আরেক ধরনের আইসোটোপ রয়েছে, যার পারমাণবিক ভর ১৫। এই ভারী নাইট্রোজেনের নাম হলো নাইট্রোজেন ১৫। মেসেলসন এবং স্টাল, ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরি হবার প্রক্রিয়াটি পরীক্ষার জন্য নাইট্রোজেন ১৫ সমৃদ্ধ কালচার মিডিয়াতে ই কোলাই ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি করলেন। বেশ কয়েকবার বংশবৃদ্ধি করার পর তাঁরা নিশ্চিত হলেন, ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর ভেতর সব নাইট্রোজেনই ভারী নাইট্রোজেন ১৫ তে পরিণত হয়েছে।
তারপর তাঁরা সেই ব্যাকটেরিয়াকে নাইট্রোজেন ১৪ সমৃদ্ধ কালচার মিডিয়াতে স্থানান্তরিত করলেন। এই নূতন কালচার মিডিয়াতে নাইট্রোজেন ১৫ এর অস্তিত্ব ছিল না। তাঁরা নূতন মিডিয়াতে আবার ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি করলেন। তারপর সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্র দিয়ে ব্যাকটেরিয়ার ভেতর থেকে ডিএনএ পৃথক করলেন। তাঁরা দেখলেন, প্রথম প্রজন্মের ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএর ভেতর সমপরিমাণ, অর্থাৎ অর্ধেক নাইট্রোজেন ১৫ এবং অর্ধেক নাইট্রোজেন ১৪ রয়েছে। কিন্তু এর পরের প্রজন্মের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখা গেল, নাইট্রোজেন ১৫ এর পরিমাণ প্রথম প্রজন্মের অর্ধেক হয়ে গেছে। এভাবে কয়েক প্রজন্মের ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ পরীক্ষা করে তারা দেখলেন, নাইট্রোজেন ১৫ এর পরিমাণ পর্যায়ক্রমে কমে গেছে কিন্তু সেই সাথে একই হারে নাইট্রোজেন ১৪ এর পরিমাণ বেড়েছে। এই সহজ সুন্দর পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা বুঝতে পারলেন, ওয়াটসন এবং ক্রিকের ধারণাটিই সঠিক ছিল। একটি পুরানো স্ট্র্যান্ড এবং একটি নতুন স্ট্র্যান্ড মিলে ডিএনএ ডবল হিলিক্সের প্রতিলিপি তৈরি হচ্ছে। সেজন্য নতুন মিডিয়াতে ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরী হবার সময় নাইট্রোজেন ১৫ এর পরিমাণ অর্ধেক হারে কমেছে। ডিএনএ প্রতিলিপি তৈরি হবার এই প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, সেমি-কনজারভেটিভ ডিএনএ রেপ্লিকেশন।
মেসেলসন এবং স্টালের এই যুগান্তকারী পরীক্ষার ফলে ডিএনএ ডবল হিলিক্স মডেলের স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেল। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা গেল, ডিএনএ কিভাবে বংশগতির ধারাকে রক্ষা করে। পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করে মলিক্যুলার বায়োলজিতে অনেক বড় বড় কাজ হয়েছে। অবশ্য জেমস ওয়াটসন তখন বলেছিলেন, তাঁদের আবিষ্কৃত ডিএনএ ডবল হিলিক্স মডেলের স্বপক্ষে মেসেলসন এবং স্টালের পরীক্ষাটি অপরিহার্য ছিল না। কিন্তু জেমস ওয়াটসনের বিরোধিতা সত্ত্বেও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, মেসেলসন এবং স্টালের এই পরীক্ষাটি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিল। তাঁদের মতে, এই সহজ সুন্দর পরীক্ষাটি ছিল, দি মোস্ট বিউটিফুল এক্সপেরিমেন্ট ইন বায়োলজি, জীববিজ্ঞানের সুন্দরতম পরীক্ষা।
এখন থেকে ৬৩ বছর আগে, জীববিজ্ঞানের সুন্দরতম পরীক্ষাটি করেছিলেন ম্যাথিউ মেসেলসন এবং ফ্রান্ক স্টাল।
তাদের দুজনের বয়সই এখন নব্বইয়ের উপর। আসুন, এই ভিডিওতে দুই বিজ্ঞানীর মুখ থেকেই তাঁদের গল্পটি শোনা যাক।
ভিডিও লিংক
https://youtu.be/7-tnuAqEp9g
Comments