জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ

মহাকাশে স্থাপিত হতে যাচ্ছে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। সংক্ষেপে একে বলা হয়, JWST বা শুধুই ওয়েব। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এবং ক্যানেডিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ উদ্যোগে এই অত্যাধুনিক টেলিস্কোপটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই টেলিস্কোপ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় দশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।  এটি হবে মহাকাশে স্থাপিত সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধুনিক স্পেস টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপটির নামকরণ করা হয়েছে নাসার প্রাক্তন সফল প্রশাসক জেমস ওয়েবের নাম অনুসারে। তাঁর আমলেই নাসা সফলভাবে অ্যাপোলো প্রোগ্রাম পরিচালনা করে চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল। 

১৯৯০ সালে মহাকাশে স্থাপিত হয়েছিলো হাবল স্পেস টেলিস্কোপ। ৩১ বছর ধরে এটি এখনো মহাশূন্যে কর্মক্ষম রয়েছে। হাবল স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাজাগতিক অনেক দূরবর্তী বস্তুর বিস্ময়কর ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে। এ ধরণের অনেক ছবি আমরা ইন্টারনেটে দেখেছি।‌ হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে মহাবিশ্বের গঠন সম্বন্ধে বিজ্ঞানীরা অনেক নুতন তথ্য পেয়েছেন। এখানে বলে রাখি, সম্প্রতি হাবল টেলিস্কোপের  কম্পিউটার সফটওয়্যার আপডেট করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, হাবল স্পেস টেলিস্কোপটি আরো বেশ কয়েক বছর কাজ করতে পারবে।কিন্তু এর কর্ম ক্ষমতা শেষ হবার আগেই  জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটিকে  হাবল টেলিস্কোপের পরিপূরক হিসেবে মহাকাশে পাঠানো হচ্ছে। 

এই নতুন টেলিস্কোপটি নির্মাণে আরো অনেক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ওয়েব টেলিস্কোপের প্রাথমিক আয়নার ব্যাস ৬.৫ মিটার।  হাবল টেলিস্কোপের ২.৪ মিটারের আয়নার চেয়ে এটি অনেক বড়  এবং অনেক বেশি সংবেদনশীল। ওয়েব টেলিস্কোপটি কাজ করবে মূলত ইনফ্রারেড তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। এর ফলে মহাবিশ্বের অনেক দূরবর্তী স্থানে এবং মহাজাগতিক ধূলিকণার অন্তরালেও এর দৃষ্টি পৌঁছে যাবে। হাবল টেলিস্কোপে যেসব দূরবর্তী মহাজাগতিক বস্তুকে দেখা যায় না, ওয়েব টেলিস্কোপের সাহায্যে সে সব বস্তুর স্পষ্ট ছবি তোলা সম্ভব হবে।  বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি হবে হাবল টেলিস্কোপের চেয়ে একশ গুণ বেশি শক্তিশালী। এটি আগামী এক দশক পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকবে।  

হাবল টেলিস্কোপের সাথে ওয়েব  টেলিস্কোপের আরেকটি পার্থক্য হচ্ছে মহাকাশে এর অবস্থান। হাবল টেলিস্কোপটি রয়েছে পৃথিবীর নিম্নকক্ষ পথে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব হলো মাত্র ৫৪৭ কিলোমিটার। কিন্তু মহাকাশে ওয়েব টেলিস্কোপের অবস্থান হবে লা গ্র্যান্জ পয়েন্ট টুতে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার। লা গ্র্যান্জ পয়েন্টে পৃথিবী এবং সূর্যের সম্মিলিত মহাকর্ষ বল সাম্যবস্থায় থাকে। ওখানে কোন মহাকাশযান স্থাপন করা হলে সেটি পৃথিবীর তুলনায় আপাত স্থির অবস্থায় থাকবে। এর ফলে মহাকাশযানের জ্বালানি খরচ অনেক কম হবে। পৃথিবী থেকে অনেক দূরবর্তী এই অবস্থান থেকে ওয়েব টেলিস্কোপ ইনফ্রারেড আলোতে পর্যবেক্ষণ করবে সমগ্র মহাবিশ্বকে। আশা করা যাচ্ছে, আদি মহাবিশ্ব সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য জানা যাবে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক নতুন আবিষ্কারের সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। 

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এখন থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাংয়ের  ফলে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিলো।  এর পর ধাপে ধাপে দৃশ্যমান গ্যালাক্সিগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। ‌সৃষ্টির আদি লগ্নে গ্যালাক্সিগুলোর অভ্যন্তরীণ অবস্থা কেমন ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেটা জানতে চান। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সাহায্যে ১৩.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের মহাজাগতিক বস্তু সমূহকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।  তার মানে হলো, মহা বিস্ফোরণের পর প্রাথমিক মহাবিশ্বের গঠন প্রকৃতি কেমন ছিলো সেটা বিজ্ঞানীরা জানতে পারবেন। মোদ্দা কথা হলো, সৃষ্টির আদি লগ্নের সুদূর অতীতকে তাঁরা সরাসরি দেখতে পারবেন। এর ফলে আদি মহাবিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান অনেক বৃদ্ধি পাবে। এর জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।  

সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁরা সম্পন্ন করেছেন। টেলিস্কোপটিকে এখন উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এই উৎক্ষেপণটি করা হবে  ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির বৃহদাকার এরিয়ান ৫ রকেটের সাহায্যে। কথা ছিল, আগামী ১৮ ডিসেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার ফ্রেঞ্চ গিয়ানা থেকে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপকে নিয়ে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে এরিয়ান ৫ রকেট।  কিন্তু জানা গেছে, টেলিস্কোপটিকে রকেটের সাথে সংযুক্ত করার সময় একটি ছোট্ট সমস্যা হয়েছে। সেজন্য উৎক্ষেপণের দিন কিছুটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ২২ ডিসেম্বরের পর উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হবে। এখন তারই জোর প্রস্তুতি চলছে। আশা করছি, এই উৎক্ষেপণটি নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে সম্পন্ন হবে এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ কাঙ্খিত কক্ষপথে পৌঁছে নির্ধারিত মিশন শুরু করবে।‌ টেলিস্কোপটি পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করলে মহাবিশ্ব সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের সার্বিক সাফল্য কামনা করছি। 

বিস্তারিত তথ্যের জন্য:
https://www.jwst.nasa.gov/

Comments