কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা

সপ্তদশ শতাব্দীতে স্যার আইজ্যাক নিউটন আলোক রশ্মি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছিলেন।  তিনি  একটি প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্য রশ্মির বিচ্ছুরণের প্যাটার্ন লক্ষ্য করে বুঝতে পেরেছিলেন আলো সবসময় সরল রেখায় চলে। ‌ তিনি বলেছিলেন, এক বিশেষ ধরনের  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে আলোকরশ্মি গঠিত। ‌ তাঁর আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল আলোক রশ্মি এক ধরনের তরঙ্গ। 

এরপর ১৮০১ সালে পদার্থবিজ্ঞানী থমাস ইয়াং একটি  সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে আলোক রশ্মির তরঙ্গ ধর্মকে আবার প্রমাণ করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানে এটি ডবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট (Double Slit Experiment) নামে সুপরিচিত। একটি বাক্সের মধ্যে তিনি একটি অস্বচ্ছ পর্দা রেখে তার মধ্যে পাশাপাশি দুটো সরু এবং সমান্তরাল স্লিট তৈরি করলেন, যাতে ওদের ভেতর দিয়ে আলোক রশ্মি প্রবাহিত হতে পারে।  স্লিট মানে হলো লম্বালম্বিভাবে চেরা বা কাটা। তারপর তিনি আয়নার সাহায্যে বাক্সের ভেতর সূর্যের আলো প্রবেশ করালেন। সৌররশ্মি চিকন স্লিট দুটোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপরীত দিকে একটি পর্দার উপরে  গিয়ে পড়লো। আলো সব সময় সরলরেখায় চলে, তাই থমাস ইয়াং ভেবেছিলেন স্লিট দুটোর ঠিক বিপরীতে লম্বালম্বি দুটো সমান্তরাল আলোর রেখা দেখা যাবে।  কিন্তু না, মজার ব্যাপার হলো দুটোর পরিবর্তে তিনি পর্দার উপর পাশাপাশি অনেকগুলো উজ্জ্বল এবং অনুজ্জ্বল সমান্তরাল  আলোর রেখা দেখতে পেয়েছিলেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ইয়াং প্রমাণ করেছিলেন আলোক রশ্মি আসলে তরঙ্গের আকারে চলে। সেজন্য আলোক রশ্মি স্লিট দুটোর ফাঁক গলে দুটো তরঙ্গ হিসেবে বেরিয়ে আসার পর, পরস্পরের সাথে ব্যতিচারের (interference) ফলে দুইয়ের অধিক আলোক তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। ‌আলোক তরঙ্গের এই ব্যতিচারের প্যাটার্নটি পেছনের পর্দায় অনেকগুলো উজ্জ্বল এবং অনুজ্জ্বল সমান্তরাল  আলোর রেখা  হিসাবে দেখা দিয়েছে। আলোর তরঙ্গের শীর্ষবিন্দু গুলো যেখানে মিশেছে সেখানে আলোর রেখাগুলোর  উজ্জলতা বৃদ্ধি পেয়েছে (ছবিতে দেখুন)।  

এই ডবল স্লিট পরীক্ষার পর আলোক রশ্মির তরঙ্গ ধর্ম নিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে কোন সন্দেহ রইলো না। একশ বছরের কিছুটা বেশি সময় নির্বিঘ্নেই কাটলো। ‌কিন্তু ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন এসে এক আজব কথা শুনালেন। তিনি বললেন, আলো আসলে এক বিশেষ ধরনের কোয়ান্টাম কণা দিয়ে তৈরি। আলোর উৎস থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তির আকারে এসব কোয়ান্টাম কণা নির্গত হয়। তিনি আরো বললেন, এসব  কণা যখন কোন ধাতব পদার্থের ওপর আঘাত করে, তখন  আলোর কণার সম্পূর্ণ শক্তি  ধাতব পদার্থের ইলেকট্রনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ‌একে বলা হয় ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট। এখানে বলে রাখি, ফটো ইলেকট্রিক এফেক্ট আবিষ্কারের জন্যই আইনস্টাইনকে পদার্থবিজ্ঞান ১৯২১ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো, তাঁর বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের  জন্য নয়। 

বিজ্ঞানীরা আলোর কণার নাম  দিয়েছেন ফোটন।  কিন্তু প্রশ্ন হলো আলো যদি কণাই হয়ে থাকে, তাহলে তার তরঙ্গ ধর্ম কোত্থেকে এলো? বিজ্ঞানীরা এর উত্তরে বললেন, আলো আসলে একই সাথে তরঙ্গ এবং কণা দুই অবস্থায় থাকতে পারে। সেজন্য এর দুটো চরিত্রই রয়েছে। একে বিজ্ঞানীরা বলেন, পার্টিক্যাল-ওয়েভ ডুয়ালিটি। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা। 

কিন্তু সমস্যা হলো, একই সাথে আমরা আলোর কণা ও তরঙ্গ দুটো চরিত্র দেখতে পাই না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র প্রয়োগ করে বিজ্ঞানীরা আরো বললেন, আলোর কণার মতো বস্তুকণাদেরও তরঙ্গ ধর্ম রয়েছে।  কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরিভাষায় একে বলা হয় ওয়েভ ফাংশন। বিংশ শতাব্দীতে এসে বস্তুকণার ওয়েভ ফাংশন প্রমাণ করার জন্য  বিজ্ঞানীরা আবার ডবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টের শরণাপন্ন হলেন। তবে এবার তাঁরা আলোর পরিবর্তে ব্যবহার করলেন ইলেকট্রনের প্রবাহ।  এজন্য ডবল স্লিট পরীক্ষাটিকেও তাঁরা কিছুটা পরিবর্তন করলেন। ডবল স্লিটের পরিবর্তে তাঁরা ব্যবহার করলেন ইলেকট্রন বাই-প্রিজম। এই বাই-প্রিজমের কাজ হলো ইলেকট্রনের প্রবাহকে সমান দু'ভাগে ভাগ করে একটি ডিটেক্টর স্ক্রিনের উপরে ফেলা। ইলেকট্রন প্রবাহের বাই-প্রিজম পরীক্ষাতে দেখা গেল ডিটেক্টর স্ক্রিনের উপরে আলোর তরঙ্গের মতোই ব্যাতিচারের প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা তখন ভাবলেন, ইলেকট্রন প্রবাহ অনেকটা আলোর তরঙ্গের মতোই ব্যবহার করছে। তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, একটি একটি করে ইলেকট্রন তাঁরা বাই-প্রিজম দিয়ে ডিটেক্টর স্ক্রিনে পাঠাবেন। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। তাঁরা এবার প্রতি সেকেন্ডে একটি করে ইলেকট্রন বাই প্রিজম দিয়ে পাঠিয়ে পরীক্ষাটি আবার করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ঘন্টাখানেক পর দেখা গেল ডিটেক্টর স্ক্রিনে আগের মতই ব্যতিচারের প্যাটার্নটি তৈরি হয়েছে। (ছবি দেখুন)।   এবার কিন্তু একই সাথে দুটি ইলেকট্রন ছোড়া হয়নি। অথচ দেখে মনে হচ্ছে, একটি ইলেকট্রন তরঙ্গ দুভাগ হয়ে নিজের ভেতরেই ব্যতিচার সৃষ্টি করেছে। এটা কিভাবে সম্ভব?  বিজ্ঞানীরা তখন নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাই প্রিজমের  ইলেকট্রন নির্গমনের পথে প্রাথমিক ডিটেক্টর বসালেন। আবার পরীক্ষা চালু হলো। প্রাথমিক ডিটেক্টরে বিজ্ঞানীরা আগেভাগেই দেখতে পেলেন বাই-প্রিজমের দুই পথেই  একটি একটি করে ইলেকট্রন বের হচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, এবার পেছনের ডিটেক্টর স্ক্রিনে ব্যতিচারের কোন প্যাটার্ন তৈরি হলো না। শুধু দুটো মাত্র সমান্তরাল লাইন তৈরি হলো। তাহলে কি  ইলেকট্রন তাদের তরঙ্গ চরিত্র হারিয়ে আবার কণায় পরিণত হয়েছে ? পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা এবার বাই-প্রিজমের ইলেকট্রন শনাক্ত করার প্রাথমিক ডিটেক্টর সুইচটি বন্ধ করে দিলেন। অতীব আশ্চর্যের বিষয় হলো, ইলেকট্রন তখন তার তরঙ্গ চরিত্র আবার ফিরে পেল। পেছনের ডিটেক্টর স্ক্রিনে  ব্যাতিচারের প্যাটার্নটি আবার ফিরে এলো।‌  অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইলেকট্রন যেন বুঝতে পারছে কেউ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে এবং কখন তাকে কি আচরণ করতে হবে! 

ইলেকট্রনের এই অদ্ভুত আচরণের  ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, যেই মুহূর্তে ডিটেক্টর দিয়ে ইলেকট্রনকে শনাক্ত করা হচ্ছে, সেই মুহুর্তেই তার ওয়েভ ফাংশনের অবসান হয়ে কণা চরিত্র আবার ফিরে আসছে। তার মানে হলো,  ইলেকট্রন যখন বাহ্যিক অন্য কোন কিছুর সংস্পর্শে আসছে তখনই তার তরঙ্গ চরিত্র হারিয়ে যাচ্ছে। সেজন্যই বস্তুকণার দুই রূপ একই সাথে আমরা কখনো দেখতে পাই না। কারণ পর্যবেক্ষক দেখা মাত্রই তার তরঙ্গ চরিত্র হারিয়ে যাবে। 

কোয়ান্টাম জগতে বস্তুকণার চরিত্র অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আবদ্ধ। অন্যভাবে বলতে হয়, বস্তুকণার কোয়ান্টাম জগতের  নিয়মাবলী বড়ই বিচিত্র। এই জগতে একই বস্তুকণা একই সাথে একাধিক অবস্থানে থাকতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরিভাষায় একে বলা হয় সুপারপজিশন।  এছাড়াও এ জগতে রয়েছে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলম্যান্ট এবং কোয়ান্টাম টানেলিং এর মত অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার। স্বল্প পরিসরে এসব নিয়ে এখন আর আলোচনা করছি না।  গাণিতিকভাবে কোয়ান্টাম কণার এসব অদ্ভুত আচরণের  ব্যাখ্যা দেওয়া গেলেও  বাস্তব জগতে একে উপলব্ধি করাটি কঠিন। তার  কারণ হলো আমাদের পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমান জগতের নিয়মের সাথে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোয়ান্টাম জগতের নিয়মাবলী মেলে না। নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান একবার  বলেছিলেন, "কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ব্যাপার-স্যাপার আসলে কেউ কিছু জানে না"। কথাটি ঠাট্টাচ্ছলে বললেও এর মাধ্যমে  অতিক্ষুদ্র জগতের অনেক গূঢ় এবং অজানা রহস্যের প্রতি তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। অজানাকে জানাই হলো বিজ্ঞানের লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য পূরণে বিজ্ঞানীরা অবিরাম কাজ করে চলেছেন।

Comments