অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফি কিভাবে করবেন?

বছর তিনেক হয় আমি নিয়মিতভাবেই রাতের আকাশের ছবি তুলছি। আমার তোলা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের (Millky way‌ galaxy) বেশ কিছু ছবি ইতিমধ্যে ফেইসবুকে পোস্ট করেছি। ছবিগুলো দেখে অনেকেই আগ্রহী হয়েছেন। অনেকেই মেসেঞ্জারে অথবা ফোনে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন ছবিগুলো কিভাবে তুলেছি। সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে উত্তর দেওয়ার চেয়ে ভাবলাম, অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফি নিয়ে একটি পোস্টিং দেই, তাহলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই উপকৃত হবেন। 

অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফির জন্য প্রথমে আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে শহর থেকে দূরে নির্জন এবং অন্ধকার কোন স্থান। যেখানে আলোক দূষণ নেই বললেই চলে। যে কোনো বড় শহরে রাতের বেলায় প্রচুর আলো জ্বলে। সেজন্য বড় শহরগুলো থেকে রাতের আকাশের তারকামন্ডলী, অসংখ্য নক্ষত্ররাজি, বিশেষত আকাশগঙ্গা ছায়াপথ এসব কিছুই দেখা যায়না। তবে শহর থেকে দূরে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকালেই দেখবেন, রাতের আকাশ কত সুন্দর, কত মোহনীয়। মহাকাশে সুবিস্তৃত আকাশগঙ্গাও পরিষ্কার দেখতে পাবেন। অন্ধকারের যে একটি অপরূপ রূপ রয়েছে, সেটিও বিলক্ষণ বুঝতে পারবেন। এখন শুধু ছবি তোলার অপেক্ষা। 

স্থান নির্বাচন করার পর আপনাকে ছবি তোলার সময়টি নির্বাচন করতে হবে। রাতের আকাশের ছবি তোলার জন্য কৃষ্ণপক্ষই উত্তম সময়। অমাবস্যার রাত হলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে অমাবস্যার পরের তিন-চার রাত ও ভালো সময়। এ সময় আকাশে চাঁদ থাকে না, বা বেশিক্ষণ চাঁদের আলো থাকে না। মোদ্দা কথা হলো, আকাশ যত অন্ধকার হবে, মহাকাশের ছবি তোলাটা ততই সহজ হয়ে যাবে। আমি সাধারণত কৃষ্ণপক্ষে সূর্য ডোবার তিন-চার ঘণ্টা পর ছবি তোলার কাজ শুরু করি। আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। এখানে শীতের সময়, অর্থাৎ জুন মাস থেকে শুরু করে অক্টোবর মাস পর্যন্ত অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফির জন্য সুন্দর সময়। এসময় আকাশগঙ্গার উজ্জ্বল কেন্দ্রটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। 

এবার আসুন ক্যামেরার কথায়। মহাকাশের ছবি তোলার জন্য আপনার একটি ডিজিটাল এস এল আর (DSLR) ক্যামেরার প্রয়োজন হবে। ফুল ফ্রেম (Full frame) ক্যামেরা হলে ভালো হয়। তার কারণ হলো ফুল ফ্রেম ক্যামেরার সেন্সরের সাইজ APS-C ক্যামেরার সেন্সরের চেয়ে বড় হয়। সেজন্য কম আলোতে ফুল ফ্রেম ক্যামেরা ভালো কাজ করে। মনে রাখবেন, রাতের বেলা ছবি তোলা হয় অত্যন্ত কম আলোতে। ফটোগ্রাফাররা একে বলেন, লো লাইট ফটোগ্রাফি। সুতরাং আপনার ক্যামেরার সেন্সর যত সেনসিটিভ হবে, আপনার ছবির কোয়ালিটি তত ভালো হবে। আমি ক্যানন 6D Mark II ক্যামেরা ব্যবহার করি রাতের ছবি তোলার জন্য। তবে আজকাল বাজারে আরো অনেক ভালো ভালো ক্যামেরা পাওয়া যায়, যেগুলো দিয়ে খুব সুন্দর রাতের ছবি তোলা যায়। মিররলেস ক্যামেরাগুলোও বেশ ভালো। আপনি আপনার বাজেটের দিকে খেয়াল রেখে ক্যামেরা নির্বাচন করুন।

এবার আসুন লেন্সের ব্যাপারে। রাতের ছবি তোলার জন্য সঠিক লেন্স নির্বাচন করাটা খুবই জরুরী। আগেই বলেছি রাতের ছবি তোলা হয় অত্যন্ত কম আলোতে। সুতরাং আপনাকে এমন একটি লেন্স ব্যবহার করতে হবে যেটির অ্যাপারচার (aperture) যথেষ্ট বড়। সাধারণত F 2.8 বা এর চেয়ে কম হলে ভালো হয়। 

ফোক্যাল লেঙ্থের (focal length) ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। মহাকাশের ছবি তোলার জন্য আপনার দরকার হবে একটি ওয়াইড এঙ্গেল লেন্স। ফোক্যাল লেঙ্থ 24mm বা এর কম হলে ভালো হয়। এখানে বলে রাখি, অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফিতে লেন্সের ফোকাল লেঙ্থের সাথে ক্যামেরার এক্সপোজার টাইমের (exposure time) একটি সম্পর্ক রয়েছে। একে বলা হয়, রুল অফ ফাইভ হান্ড্রেড (rule of 500)। এটির একটু ব্যাখ্যা দিচ্ছি। মনে করুন, আপনি অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফির জন্য 20mm ফোকাল লেঙ্থের একটি লেন্স ব্যবহার করছেন। এই লেন্স ব্যবহার করে আপনি সর্বোচ্চ, 500/20 = 25 সেকেন্ড পর্যন্ত আপনার ক্যামেরার শাটার ওপেন রাখতে পারবেন। কিন্তু আপনি যদি 14mm ফোকাল লেঙ্থের লেন্স ব্যবহার করেন তাহলে আপনি আরো বেশি সময় (500/14 ~ 35) অর্থাৎ প্রায় 35 সেকেন্ড পর্যন্ত এক্সপোজার টাইম দিতে পারবেন ক্যামেরায়। এর চেয়ে বেশি সময় এক্সপোজার দিলে ছবিতে নক্ষত্র গুলো স্থির থাকবে না, ছবিতে star trail দেখা যাবে। ছবি তোলার সময় এক্সপোজার টাইমটি আপনাকে ঠিক করে নিতে হবে। আমি সাধারণত 20 থেকে 25 সেকেন্ড এক্সপোজার দিয়ে ছবিগুলো তুলি। 

মহাকাশের একটি বড় অংশকে ছবিতে ধারণ করার জন্য কম ফোকাল লেঙ্থের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স ব্যবহার করা ভালো। তবে 14mm এর নিচে যাবার দরকার নেই। এর বেশি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল হলে ছবিতে ফিশ আই (fish eye) এফেক্ট চলে আসবে। আমি সাধারণত রাতের আকাশের ছবি তোলার জন্য, Rokinon F 2.8 14mm ম্যানুয়াল প্রাইম লেন্স ব্যবহার করি। দক্ষিণ কোরিয়ায় নির্মিত এই লেন্সটি অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফির জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লেন্স। মনে রাখবেন অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফিতে অটোফোকাসের কোন দরকার নেই। ম্যানুয়াল পদ্ধতিই যথেষ্ট। 

ক্যামেরা হলো, লেন্স হলো, এখন আসুন ট্রাইপডে। অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফির জন্য আপনার একটি শক্ত ও সুদৃঢ় ট্রাইপড দরকার হবে। যাতে ছবি তোলার সময় ক্যামেরা কোনোভাবেই নড়াচড়া না করে। 

রাতের বেলায় আপনার নির্বাচিত স্থানে গিয়ে ক্যামেরা ট্রাইপডের উপর ফিট করুন। সাথে ছোট টর্চলাইট রাখবেন। নইলে নিকষ অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাবেন না। এবার টর্চ নিভিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখুন ছায়াপথকে দেখতে পাচ্ছেন কিনা। আকাশ অন্ধকার এবং মেঘমুক্ত হলে অবশ্যই ছায়াপথকে খুঁজে বের করতে আপনার কোন অসুবিধা হবে না। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দেখবেন দুধসাদা আকাশগঙ্গা বয়ে চলেছে। এটাই আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। এরই এক প্রান্তে আমরা বসবাস করি।

এবার ছবি তোলার পালা। 
ক্যামেরাকে ম্যানুয়াল মোডে নিয়ে নিন। লেন্স অটোফোকাসে থাকলে সেটাকেও ম্যানুয়াল ফোকাস করে নিন। তারপর ক্যামেরাকে আকাশগঙ্গার দিকে তাক করুন। ক্যামেরার লাইভ ভিউতে ছায়াপথের কাছাকাছি যে কোন উজ্জ্বল নক্ষত্রকে চিহ্নিত করে সেটাকে ক্যামেরার ফোকাসে নিয়ে আসুন। এরপর ক্যামেরার লেন্সের অ্যাপারচার 2.8 এ সেট করুন, শাটার  স্পিড 20 সেকেন্ডে এ সেট করুন। আইএসও (ISO) সেট করুন 10000 এ, হোয়াইট ব্যালেন্স অ্যাম্বিয়েন্ট লাইটে (3200K) রাখুন। আরেকটা জিনিস খেয়াল রাখবেন, ছবিটি তুলবেন RAW মোডে। তাতে প্রোস্ট প্রসেসিংয়ের সুবিধা হবে। 

সবকিছু ঠিকঠাক মতো সেট করার পর দুই সেকেন্ড ডিলে দিয়ে শাটার রিলিজ করুন। অথবা রিমোট ব্যবহার করতে পারেন। এটা করা হয় শাটার চাপার সময় ক্যামেরা যাতে নড়াচড়া না করে। এবার 20 সেকেন্ড অপেক্ষা করুন। ছবি তোলা হয়ে গেলে, ক্যামেরায় এলসিডি স্ক্রিনে ছবিটি দেখুন। দেখবেন অসংখ্য নক্ষত্রসহ ছায়াপথ আপনার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। ছবিটিতে আলো কম বা বেশি হলে শাটার স্পিড বাড়িয়ে বা কমিয়ে সেটা এডজাস্ট করতে পারেন। এভাবে প্রচুর ছবি তুলুন। দেখবেন এর মধ্য থেকে বেশ কিছু ছবি খুব ভালো হয়েছে। এরপর অবশ্য পোস্ট প্রসেসিংয়ের ব্যাপার স্যাপার রয়েছে।‌ সেটা আমি লাইট রুমে ক্রিয়েটিভ ক্লাউডে করি। সেটি নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। 

আপাতত মনের আনন্দে রাতের আকাশের ছবি তুলতে থাকুন। দেখবেন এ এক আশ্চর্য অনুভূতি।

Comments