করোনার লিঙ্গবৈষম্য


সারা পৃথিবী জুড়ে করোনা রোগীদের পরিসংখ্যান দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই রোগে নারীদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আর এই রোগে পুরুষরাই অধিক হারে মারা যাচ্ছেন। কোন কোন দেশে পুরুষদের মৃত্যুর হার নারীদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। লিঙ্গ ভেদে কোভিড ১৯ রোগ বিস্তারের ব্যাপক তারতম্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বুঝতে এখন পারেছেন এর প্রধান কারণটি হলো জেনেটিক।

পুরুষ এবং নারীর মধ্যে একটি বিশেষ জেনেটিক পার্থক্য রয়েছে। ‌এই পার্থক্যের মূল কারণ নিহিত রয়েছে মানুষের ক্রোমোজোমের ভেতর। মানুষের কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে। এর মধ্যে এক জোড়া ক্রোমোজোম অন্য সব ক্রোমোজোমের চেয়ে আলাদা। এদেরকে বলে সেক্স ক্রোমোজোম। মানুষের কোষে দু'ধরনের সেক্স ক্রোমোজোম রয়েছে, এদের নাম হলো এক্স (X) এবং ওয়াই (Y) ক্রোমোজোম। মানুষের কোষে যদি দুটো এক্স ক্রোমোজোম (XX) থাকে, তাহলে সে হবে নারী। কিন্তু যদি একটি এক্স এবং একটি ওয়াই (XY) ক্রোমোজোম থাকে‌ তাহলে সে হবে পুরুষ। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যেই করোনা ভাইরাসের লিঙ্গবৈষম্যের রহস্য লুকিয়ে আছে।

বিজ্ঞানীরা জানেন এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যে রয়েছে হাজার খানেকের বেশি জিন। এর মধ্যে কয়েকটি জিন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজি বিশেষজ্ঞ ডক্টর ফিলিপ গোল্ডার বলেছেন, এক্স ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি জিন রয়েছে, যেটি মানবদেহে TLR7 নামে একটি প্রোটিন উৎপন্ন করে। এটি একটি ইমিউনো প্রোটিন (immuno-protein), এটি করোনা ভাইরাসের মতো আরএনএ ভাইরাসকে চিহ্নিত করতে পারে। সেজন্য এই প্রোটিনটি করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানব দেহের ইমিউনটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়াতে পারে। নারীর দেহে যেহেতু দুটো এক্স ক্রোমোজোম রয়েছে, সেজন্য তিনি ধারণা করছেন, নারীর ইমিউন সিস্টেমে TLR7 প্রোটিনের আধিক্য রয়েছে। এটি সম্ভবত নারীদেরকে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে পুরুষের চেয়ে অধিকতর সুরক্ষা দিচ্ছে।

এছাড়াও আরেকটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো হরমোনগত কারণ। নারীর প্রধান দুটো হরমোন এস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দেয়। পক্ষান্তরে পুরুষের হরমোন, যার নাম হলো টেস্টোস্টেরন, এই হরমোনটি অধিক মাত্রায় থাকলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে এসব রোগের কারণে বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। এটিও করোনা ভাইরাসে অধিক হারে পুরুষদের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী।

অতি সম্প্রতি আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। সেটি হলো পুরুষের অন্ডকোষে করোনা ভাইরাস অনেকদিন লুকিয়ে থাকতে পারে এবং সুযোগ বুঝে পুরুষকে আক্রমণ করতে পারে। নারীদের ডিম্বকোষের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো ঝুঁকি নেই। ‌ বোঝাই যাচ্ছে করোনা ভাইরাসের পক্ষে নারীদের চেয়ে পুরুষদের কাবু করা সহজ। ‌

এখানে বলে রাখি, পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজোমটি এক্স ক্রোমোজোমের চেয়ে সাইজে অনেক ছোট। ওয়াই ক্রোমোজোমের মধ্যে রয়েছে SRY জিন। এই জিনটি মাতৃগর্ভেই মানব ভ্রুণকে পুরুষে রূপান্তরিত করে। মানুষকে পুরুষে রূপান্তরিত করা ছাড়া ওয়াই ক্রোমোজোমের আর বিশেষ কোন কাজ নেই।

বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, দুটো এক্স ক্রোমোজোম থাকার কারণেই প্রকৃতিগত ভাবেই নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে পুরুষরা নারীদের সমকক্ষ নন।
করোনা ভাইরাস এসে সেটি প্রমাণ করে দিয়েছে।







Comments