জলবায়ু পরিবর্তন ও অস্ট্রেলিয়ার দাবানল

অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি বছরই প্রাকৃতিক নিয়মে দাবানল হয়। এদেশে একে বলে বুশফায়ার। এটি সাধারণত শুরু হয় শুষ্ক মৌসুমে, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে। দক্ষিণ গোলার্ধে তখন থাকে গ্রীষ্মকাল। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো, এ বছর বুশফায়ার সীজন শুরু হয়েছে বসন্তের শুরুতে, সেপ্টেম্বর মাস থেকে। ডিসেম্বর মাসে এসে এর ভয়াবহতা প্রচন্ড মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। 

এ পর্যন্তে বুশফায়ারে দশ লক্ষ হেক্টর বনভূমি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। কয়েক হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। নিহত হয়েছে অনেক মানুষ। ‌ লক্ষ লক্ষ বন্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। আগুনের উৎকট ধোঁয়ায় অস্ট্রেলিয়ার বিশাল অংশ ঢেকে গেছে। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে রীতিমতো অসুবিধা হচ্ছে মানুষের। পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। আগুনের লেলিহান শিখা এখনো থামেনি। ‌দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে এখনো আগুন জ্বলছে। মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। এই দাবানলের বিস্তৃতি এতই ব্যাপক যে মহাকাশ থেকেও আগুনের ধোঁয়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে গেছে অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের ধোঁয়া।‌ এই দাবানল থামানো মানুষের অসাধ্য কাজ। একমাত্র প্রবল বৃষ্টিই থামাতে পারে এই আগুন। কিন্তু সেরকম লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

গত কয়েক বছর ধরেই বৃষ্টিপাত অনেক কমে গেছে এদেশে। যার ফলে অস্ট্রেলিয়াতে ব্যাপক খরা দেখা দিয়েছে । নদী-নালা শুকিয়ে গেছে। সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। ফসলের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। ‌ সরকারি সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কৃষক সমাজ। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অর্থনীতিতে। 

অনেকেই মনে করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া এখন অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা কয়েক দশক ধরেই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলে আসছেন। তারা বলছেন, বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর জলবায়ু ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। তিরিশ বছর আগেই বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। তাঁরা আরো বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে হলে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমানো ছাড়া কোন গতি নেই। এজন্য সকল দেশ এবং জাতিকে একসাথে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বিজ্ঞানীদের কথা বিশ্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেননি। তারা অর্থনীতিকে পরিবেশের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তারা মনে করেছেন জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে গেলে সেটা অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। সেজন্য জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাটিকে তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি  অথবা সরাসরি অস্বীকার করেছেন। 

ফলে যা হবার তাই হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান বুশফায়ারের পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে অস্ট্রেলিয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এখন অনেক কমে গেছে, বনভূমি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শুষ্ক । এর সাথে সাথে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হয়েছে দাবানলের জন্য মোক্ষম পরিবেশ। বনে আগুন লাগার জন্য এখন একটু স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট। কার্যত সেটাই হয়েছে। তবে সব আগুন যে প্রাকৃতিক নিয়মে লেগেছে সেটাও ঠিক নয়। কিছু কিছু আগুন মানুষও লাগিয়েছে। তাদের অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছে। তবে একথা ঠিক যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্ট্রেলিয়াতে দাবানলের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এত ব্যাপক এবং বিশাল মাত্রার দাবানল অস্ট্রেলিয়াতে আর কখনো হয় নি। এটা একেবারেই অভূতপূর্ব ঘটনা। 

কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, এটাই শেষ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির রুদ্ররোষ ভবিষ্যতে আরো বাড়বে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবার কারণে তলিয়ে যাবে অনেক দেশ। যার মধ্যে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশও রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলের এক বিরাট এলাকা তলিয়ে যাবে সমুদ্রগর্ভে। সারা পৃথিবীতে
প্রতি বছর বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বাড়তেই থাকবে। পৃথিবীর কোন দেশ এবং জাতিই এসব ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতপক্ষে মানব সভ্যতার অস্তিত্বই ভবিষ্যতে হুমকির সম্মুখীন হবে। এ ব্যাপারে যারা এখনো সন্দেহ প্রকাশ করছেন তাদের উচিত হবে অস্ট্রেলিয়ার বুশফায়ার স্বচক্ষে এসে দেখে যাওয়া। 

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? আসলে এ ব্যাপারে অনেক আগেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবুও বিজ্ঞানীরা বলছেন এখনো সময় আছে আমাদের কার্বন ফুট-প্রিন্ট কমানোর। সেই লক্ষ্যে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায়ে আমাদের গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। প্রচুর গাছপালা লাগাতে হবে। সম্পদের অপচয় কমিয়ে রিসাইকেল বাড়াতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এই গ্রহটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেলে আমাদের আর কোন বাসভূমি কিন্তু নেই।

Comments