বিজ্ঞানীরা মনে করেন এখন থেকে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং এর ফলে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলেন, এই মহাবিস্ফোরণের পর প্রথম তিনটি মিনিট ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ধারণা, মহাবিশ্বের যাবতীয় প্রাথমিক বস্তুকণা এই প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিল। মহাবিস্ফোরণের শক্তি থেকে প্রাথমিক বস্তুকণার রূপান্তর কিভাবে হয়েছিল তার ব্যাখ্যা তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন। তারা বলেন, মহাবিস্ফোরণের ফলে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় প্রচন্ড শক্তি নির্গত হয়। ট্রিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রার এই মহাশক্তি থেকে খুব দ্রুতই কিছু প্রাথমিক বস্তুকণার উদ্ভব হয় যা প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই কয়েক ধাপে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হয়েছিল। এর পরপরই মহাবিশ্বের প্রসারণ শুরু হয়, যা এখনো ক্রমেই প্রসারিত হয়েই চলেছে। পরবর্তীতে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম পরমাণু মহাকর্ষের ফলে পুঞ্জীভূত হয়ে বিভিন্ন নক্ষত্র, নেবুলা এবং গ্যালাক্সির জন্ম দেয়, যা এখন আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের অংশ।
তিন মিনিট কোন দীর্ঘ সময় নয়। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ক্ষণস্থায়ী প্রাথমিক কণার উদ্ভব কিভাবে হলো। আর এই কণাগুলোর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফলে এই অল্প সময়ের মধ্যেই কেমন করে শক্তি থেকে বস্তুর সৃষ্টি হলো। এর মধ্যে একটি কণা, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন হিগস বোসন, খুবই গুরুত্ব পূর্ণ। তারা মনে করেন, এই কণাটি থেকেই বস্তুর ভরের (mass) উৎপত্তি হয়। আইনস্টাইন তার বিখ্যাত সমীকরণে দেখিয়েছেন বস্তুকে শক্তিতে রূপান্তর করা যেমন সম্ভব , তেমনি শক্তিকেও বস্তুতে রূপান্তর করাও অসম্ভব নয়। সৃষ্টির সূচনায় এই অসম্ভবটিই সম্ভব করেছিলো হিগস বোসন, যাকে অনেকে বলে "ঈশ্বর কণা"।
এগুলি সবই তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের কথা। কিন্ত শুধু তত্ত্ব দিলেই তো হবেনা। তত্ত্ব প্রমান করা চাই। হিগস বোসনকে খুঁজে বের করাটা তাই খুবই জরুরী।
আর এই কাজটিই করছেন সার্নের বিজ্ঞানীরা। সার্ন (CERN) হলো ইউরোপিয়ান নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সংক্ষিপ্ত নাম। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সেলেটর, লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (LHC), এখানেই অবস্থিত।
এল এইচ সি দিয়েই তারা মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন। এটা করতে হলে কিছু কৃত্রিম বিগ ব্যাং ঘটাতে হবে এল এইচ সির ভেতর। তাহলেই পদার্থের আদিম রূপটি দেখা যেতে পারে।
ভূপৃষ্ঠের ১০০ মিটার নিচে এল এইচ সির অবস্থান। এর ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ চক্রাকার টানেল চলে গেছে মাটির নিচ দিয়ে। এর কিছুটা অংশ ফ্রান্সের ভিতর আর কিছুটা অংশ সুইজারল্যান্ড এর মধ্যে। এর বিভিন্ন স্থানে আছে বিশাল ম্যাগনেট আর পার্টিকেল ডিটেকটর।
এল এইচ সির ভেতর খুবই উচ্চশক্তির পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়। প্রোটন কনাগুলোকে দুটি বিপরীত মুখী টিউব দিয়ে প্রচন্ড শক্তিতে পরিচালনা করে প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাদের মধ্যে ঘটানো হয় সংঘর্ষ। প্রচন্ড এই সংঘর্ষের ফলে প্রোটন কনাগুলো চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে তাদের আদি অবস্থায় ফিরে যায়। এটি হলো সেই আদি অবস্থা যেটা মহাবিশ্বের সৃষ্টির শুরুতে বিরাজমান ছিল। এই সংঘর্ষের ফলে যে সব কণা তৈরি হয় সেগুলো খুবই ক্ষনস্থায়ী, কিন্তু এল এইচ সির পার্টিকেল ডিটেকটরে সেগুলো ধরা পড়ে।
এল এইচ সির পরীক্ষায় হিগস বোসন মশাই একবার এক ঝলকের জন্য দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। তাই তাঁরা আরো উচ্চ শক্তির পরীক্ষা চালানোর অপেক্ষায় আছেন। বিজ্ঞানীদের ধারণা এভাবেই তারা একদিন সৃষ্টির প্রথম তিন মিনিটের রহস্য ভেদ করবেন।
Comments